মুজাররদ – মুহাম্মদ সৈয়দুল হক
মুহাম্মদ সৈয়দুল হকের লেখা “মুজাররদ” আমার পড়া একটি সাম্প্রতিক চমৎকার একটি বই। মুহাম্মদ সৈয়দুল হকের “মুজাররদ” বইটি একটি অসাধারণ ঐতিহাসিক বর্ণনামূলক উপন্যাস। বইটি হযরত শাহজালাল (রহ.) ও বাংলায় ইসলামি বিপ্লবের ঐতিহাসিক উপাখ্যান-এর উপর ভিত্তি করে লেখা। ত্রয়োদশ শতাব্দীর বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের সময়কার চিত্র এখানে লেখক খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে, হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর সিলেট বিজয় এবং এর পেছনের ঘটনাগুলো বইটিকে আরও বেশি ইন্টারেস্টিং করে তুলেছে। বইটি বড় ছোট সকল বয়সের পাঠকের জন্য উপযোগী বলে আমার মনে হয়েছে।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
“মুজাররদ” বইটি শুরু হয় কথকের ট্রেনের উঠার সময় থেকে। সেই ট্রেনে তার সাথে আলাপ হয় এক ৪৫/৪৬ বছর বয়সী ব্যক্তির সাথে, যার বর্ণনা করতে দিয়ে কথক বলেছেন “মধ্যযুগের মুসাফির” ধরনের। যার হাতে ছিলো “ট্রাভেলস অব ইবনে বতুতা” বইটি। কথকের সাথে শুরু হয় ইবনে বতুতাকে নিয়ে কথা। প্রায় সাত’শ বছর আগে ইবনে বতুতার চট্টগ্রাম হয়ে বাংলায় আসার কথা। সাত’শ বছর আগে বাংলা ছিলো খাজানায় ভরপুর এক দেশ, বাজার অবস্থাও সেই রকম। তবে বাংলার আবহাওয়া ইবনে বতুতার জন্য তেমন সুবিধাজনক ছিলো না বিধায় বাংলা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন –
“এ হেল ফুল অব গুড থিংস”
তবে ইবনে বতুতা বাংলায় এসব দেখতে আসেন নি। তিনি এসেছিলেন হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর সাথে দেখা করতে। কেননা পীর-দরবেশের প্রতি ছিলো তার দারুন আগ্রহ। এই কথায় কথকের হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। কথক নিজেও সিলেট যাচ্ছিলেন হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর জিয়ারতে এবং আশেপাশে ঘুরে ফিরে দেখতে। কথক যখন জানতে পারে যে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর চোখের সামনেই হালাকু খান বাগদাদকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় তখন তার আগ্রহের সীমা থাকে না। তিনি লোকটির থেকে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলেন। মুসাফির ভদ্রলোক শুরু করলেন –
“ইসলামের স্বর্ণযুগ” চলাকালে ইয়ামেনে জন্মগ্রহণ করেন হযরত শাহজালাল রহ. (আসল নাম শেখ জালাল উদ্দিন)। শিশুকাল পেরিয়ে কৈশোরে পা দেওয়ার আগেই হারান মা-বাবা দুজনকে। অল্পবয়সে এতিম হয়ে নবীজির সুন্নাতের যাত্রা শুরু করলেন। মামার হাত ধরে বেড়ে উঠতে থাকেন নবীজির প্রিয়ভূমি মক্কা নগরীতে। প্র্যাক্টিক্যাল ও থিউরিক্যাল প্রায় সকল জ্ঞান দখল করে নেন মাত্র ২১ বছর বয়সেই। তিনি বুঝলেন মক্কা-মদিনা স্থানে সীমাবদ্ধ নয় বরং মুমিনের কলবে তার মূল অবস্থান। ধীরে ধীরে তিনি নফস-কে নিয়ন্ত্রণ করেন। একে একে সুফি, দরবেশের সান্নিধ্য তাঁর প্রেরণার উন্মাদনা বাড়িয়ে দিতে থাকে। বছর কয়েক পর তিনি আবার ফিরলেন সেই বাগদাদে। শিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর কাছে নিজেকে সমর্পন করে নিজের ধ্যান-জ্ঞান বানালেন। কিছু সময় পর তার সাথে পরিচয় হয় বাহাউদ্দীন জাকারিয়ার, তিনি এসেছিলেন মুলতান থেকে। তিনি বাগদাদ থেকে আবার মুলতানে যাত্রা করলে। তাঁর সাথে যোগ দেন হযরত শাহজালাল (রহ.)। ভ্রমন করলেন মুলতান থেকে দিল্লি, বাদায়ুন, লখনৌতির পান্ডুয়া। আবার তাকে টানতে থাকে বাগদাদ। কিন্তু ততদিনে মোঙ্গলদের অত্যাচারে বাগদাদ ধ্যান-জ্ঞানের কেন্দ্র থেকে ধর্মীয় দ্বন্দের প্রাণকেন্দ্রতে পরিনত হয়। দখলের উদ্দেশ্যে ক্ষমতায় থাকা চেঙ্গিস খানের নাতি মোংকে খান তার ভাই হালাকু খানকে পাঠায় প্রায় তিন লাখ সৈন্যের বহর নিয়ে বাগদাদে হামলা করতে। শুরু করেন ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা ও নির্যাতন। বাগদাদের এই ধ্বংস তাকে চরম ব্যথিত করে। সব ছেড়ে আবার রওনা দেন মক্কা-মদিনার উদ্দেশ্যে। আবার শুরু ভ্রমন। নানান জনপদ পেরিয়ে মুলতানে আসেন আবারও। তারপর কান্দাহার, কাবুল হয়ে আজমির।
কিছুদিন পর জানলেন যেতে হবে বাংলায়, নবীজির দরবার থেকে দায়িত্ব বন্টন হয়েছে। নিজামুদ্দিন আউলিয়া একজোড়া কবুতর দিয়ে দিলেন সাথে। কবুতর এলো তাঁর সাথে সিলেটে, নাম পেল “জালালি কইতর”।
বাংলায় এলেন তিনি। বইটিতে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর বাংলায় আগমন ও অবস্থান কালের সব ঘটনা বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হয়েছে মুসাফিরের জবানীতে। কিভাবে সিলেটের মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মধ্যমণি। বাংলার মানুষের জন্য তাঁর কল্যাণের কথা, বাংলায় ইসলাম প্রচারে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভুমিকার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আজ থেকে প্রায় সাত’শ বছর আগে তার অনুসারী এবং তার টানে ছুটে আসা বহু সুফি-সাধকদের সাথে তাঁর সিলেট সহ বাংলা-জয়ের কথা বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি তাঁর ইন্তেকালে শোক নয় বরং উরস পালিত হয়। উরস অর্থ মিলনের ক্ষণ। কেননা যে একক খোদার জন্য সৃষ্টিজগতের সবকিছু থেকে বিমুখ হয়ে তিনি “মুজাররদ” হয়ে উঠেছিলেন তাঁর সাথে মিলনে আর শোক কোথায়?
বইটির শেষ হয় কথকের সিলেটে পৌঁছানোয় এবং মাজার গেইটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

লেখকের ভাষাঃ
“মুজাররদ” বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর ভাষা। আমার মতে যেকোনো বইয়ের জন্য তার লেখার ধরন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা এই বইটিতে বইটির পক্ষপাতি হয়েছে। লেখক খুব সহজ ও সাবলীল ভাষায় ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছেন। কাহিনী পড়ার সময় মনে হয় যেন আমি সেই সময়েই উপস্থিত হয়েছি। চরিত্রগুলোর বর্ণনাও খুব জীবন্ত। চরিত্রগুলোর ধারণা, কাজকর্ম সব কিছুই পাঠক নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারবে। বইটি পড়ার সময় খুবই ডিটেইলড বর্ণনার কারনে মনে হয় যে আমরা চরিত্র এবং ঘটনা গুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে যেন আমরা ট্রেনেরই কোনো এক যাত্রী যে মুসাফিরের মুখে ঘটনা শুনছি।
ঐতিহাসিক পটভূমিঃ
বইটি লেখার আগে লেখক যথেষ্ট গবেষণা করেছেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। হযরত শাহজালাল (রহ.) এবং তার সঙ্গীদের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য এই বই থেকে জানতে পারা যায়। যা ইতিহাস সম্পর্কে উৎসুক পাঠক সমাজের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমার মতামতঃ
“মুজাররদ” বইটি আমার খুব ভালো লেগেছে। ঐতিহাসিক বর্ণনা হিসেবে এটি সত্যিই অসাধারণ। লেখকের ভাষা, কাহিনীর বর্ণনা এবং ঐতিহাসিক তথ্যের গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি মনে করি, এই বইটি সবার পড়া উচিত। বিশেষ করে যারা ইতিহাস এবং ধর্মীয় কাহিনী ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি একটি চমৎকার উপহার।
সার্বিক ভাবে বলতে গেলে, “মুজাররদ” একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বই যা একইসাথে ইতিহাস, ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণ ঘটিয়েছে। এই বইটি শুধু তথ্য দেয় না, এটি পাঠকের মনে এক গভীর অনুভূতির সৃষ্টি করে।
অতিরিক্ত তথ্যঃ
- মুহাম্মদ সৈয়দুল হকের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ।
- “মুজাররদ” বইটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে।
- বইটি পড়লে ত্রয়োদশ শতাব্দীর বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির চিত্র সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
- “মুজাররদ” বইটি ধর্ম, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের একটি সুন্দর সমন্বয়।
আশা করি বইটি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা দিতে পেরেছি। বাকি সিদ্ধান্তটুকু আপনার যে আপনি বইটি পড়তে কতটুকু আগ্রহী। আমি বলবো সময় বের করে বসে পড়ুন বইটি পড়তে। আশা করি ভালো সময় কাটবে আপনার।
- বইঃ মুজাররদ
- লেখকঃ মুহাম্মদ সৈয়দুল হক
- প্রকাশনঃ দাঁড়িকমা প্রকাশনী
- পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১৬০
- প্রথম প্রকাশঃ ২০২৫
- পার্সোনাল রেটিংঃ ৮.৫/১০
- রিভিউ লিখেছেনঃ রোহানী হক
এই লেখাটা পড়ে মনে হলো, যেন আমিও সেই ট্রেনযাত্রায় ছিলাম। ইতিহাস আর কাহিনীর এমন মিশেল সত্যিই দুর্দান্ত। আরও এমন লেখা চাই।