“যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইটি বিভিন্ন যুক্তি ও যুক্তির ভ্রান্তি নিয়ে গল্পের ছলে লেখা চমৎকার একটি বই। যুক্তিবিদ্যার মত জটিল একটি বিষয়কে এত মজার ছলে যে শেখানো যায় তা আপনি “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইটি না পড়লে বুঝতে পারবেন না। “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইটিতে ২৪ টি যুক্তির ভ্রান্তি (Logical Fallacy) নিয়ে গল্প করা হয়েছে। যুক্তির ভ্রান্তিগুলো মজার সব উদাহরণের সাহায্যে বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে। যা বইটি পাঠের আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক গুন।
বইয়ের মূল চরিত্র হিসেবে থাকে হাসিব নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা এক যুক্তিপ্রেমী যুবক। যে ছাত্র জীবনে নিয়মিত বিতর্কের সাথে যুক্ত ছিল। ছাত্রজীবনে হাসিব বিতর্কিক হিসেবে বেশ পরিচিতি ছিল। যুক্তির ঘায়ে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করাই ছিল তার এক ধরনের নেশা। “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইটিতে হাসিবের চরিত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” পড়তে পড়তে আপনি এক সময় হাসিবের যুক্তি গুলোর সাথে সহমত পোষণ করতে বাধ্য হবেন। কারণ হাসিবের খন্ডিত প্রায় প্রতিটি যুক্তির পক্ষেই একাধিক উদাহরণ দেয়া হয়েছে।
হাসিব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে অনেকটা শখের বসেই গণিত-বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে গ্রামের স্কুলে যোগ দেয়। তার এই সিদ্ধান্তে তার বাবা-মা খুশি ছিল না। হাসিবের বাবা-মা চেয়েছিল সে যাতে সরকারি/বেসরকারি চাকরি করে অথবা বৃত্তি নিয়ে লেখাপড়ার জন্য দেশের বাইরে যায়। হাসিব তাদের বুঝানোর চেষ্টা করে যে, অল্প কিছুদিন সে মাটির কাছাকাছি থাকতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার বাবা-মাকে বুঝাতে পারেনি। যুক্তিপ্রেমী হাসিব হেরে যায় তার বাবা-মাকে বাবাকে বুঝাতে। অতঃপর সে তার মনের ডাকে সাড়া দিয়ে চেপে বসে আন্তঃনগর মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেনে, গন্তব্য “খোকসা”। হাসিব শোমসপুর গ্রামে এসে উঠে রহমত চাচার বাড়িতে। শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় “শোমসপুর উচ্চবিদ্যালয়”-এ। এখান থেকে শুরু হয় “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইয়ের মূল কাহিনী…
Logic is the beginning of wisdom, not the end. – Leonard Nimoy.
হাসিবের অল্প দিনের শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় “শোমসপুর উচ্চবিদ্যালয়”-এ। যেখানে তার সাথে পরিচয় হয় হাফিজ, রিতা, এনাম সহ চমৎকার কিছু শিক্ষার্থীর সাথে। এদের মধ্যে হাফিজের চরিত্রটি থাকে খুবই মজাদার। ক্লাসের শিক্ষার্থীরা তাকে “বুনোকবি” বলত। হাসিবের যুক্তিগুলোকে ছোট ছোট লাইনের মজার সব ছন্দের মাধ্যমে বইটিতে উপস্থাপন করেছে হাফিজ চরিত্রটি। আর এভাবেই শুরু হয় গল্প ও ছন্দের ছলে চমৎকার সব যুক্তির পাঠদান। বইটির আরেকটি ভালোলাগার ব্যাপার হলো, প্রায় প্রতিটি চ্যাপ্টারে অনেকগুলো কমিক দিয়ে যুক্তি গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। যা বইটি পড়ার অনেক আগ্রহ যোগায়। “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইটি পড়তে গিয়ে একবারের জন্যও আপনি বিরক্তি বোধ করবেন না বলে আমার বিশ্বাস। কারণ প্রায় প্রতিটি যুক্তি-ই গল্প আর একাধিক মজার উদাহরণের সাথে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যুক্তিবিদ্যা আসলে বেশ প্র্যাকটিক্যাল একটি বিষয়। আর লেখকও বইটিতে অসংখ্য মজার মজার প্র্যাকটিক্যাল উদাহরণের মাধ্যমে যুক্তির কনসেপ্ট গুলো উপস্থাপন করেছে। যা কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনাকে যুক্তির এক চমৎকার দুনিয়ায় নিয়ে যাবে। পড়তে পড়তে আপনি অনুভব করবেন, অকপটে আমরা যে কথাগুলোকে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করি তার মধ্যেই রয়েছে অসংখ্য যুক্তির ভ্রান্তি। আপনি অনুভব করবেন যে, আমরা আমাদের চারপাশে কত যুক্তির ভ্রান্তি নিয়ে নিয়মিত জীবন যাপন করি। আমি হলফ করে বলতে পারি “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইটি আপনাকে ভাবাবে। আপনার চিন্তার খোরাক যোগাবে।

“যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইয়ের যুক্তিগুলোর মধ্য থেকে একটি যুক্তি নিয়ে উদাহরণ দেয়া যাক। লক্ষ্য করে দেখবেন, আমরা যখন কমার্শিয়াল কোন বিজ্ঞাপনে নামকরা যেকোনো সেলিব্রেটিকে কোন কিছু রিকমেন্ড করতে দেখি তখন কিন্তু আমরা একবারের জন্যও ভাবি না যে সেলিব্রেটি বিজ্ঞাপনে জিনিসটি রিকমেন্ড করছে সে আসলে এ ব্যাপারটাতে কতটা অভিজ্ঞ বা তার রিকমেন্ডেশনটা কতটা প্রাসঙ্গিক। কিন্তু আমরা দিব্যি তা বিশ্বাস করে যাচ্ছি। এবং মার্কেটিংয়ের এই বিষয়টি খুব কাজও করছে বহু সময় ধরে। লক্ষনীয় বিষয় হলো, এখানেও আসলে যুক্তির ভ্রান্তি ঘটেছে। যাকে যুক্তিবিদ্যার ভাষায় বলা হয় “Appeal to Questionable Authority” বা “এমন কারও দোহাই দেওয়া যার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে”।
এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে যে, বিজ্ঞাপনে আমরা প্রায় সময়ই এই রকম অনেক যুক্তির ভ্রান্তি ঘটতে দেখি। যদি এগুলো ভুলই হবে, তাহলে এত ব্যবহার হয় কেন? এই প্রশ্নের উত্তর লেখক তার বইয়ে খুব সুন্দর ভাবে উল্লেখ্য করেছে। যা আপনি “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইটি পড়ার সময় আবিষ্কার করবেন। এটা আপাতত আমি এখানে গোপন রাখছি।

আমরা জাতি হিসেবে অনেক আবেগপ্রবণ হলেও বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে প্রায় সবকিছুই যুক্তির উপর নির্ভরশীল। আমাদের প্রতিনিয়ত করা অনেক কাজ এবং অনেক বিশ্বাস যে কতটা যুক্তির ভ্রান্তির মধ্যে আছে তা যেন লেখক আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অন্তত যুক্তির বেসিকটুকু বুঝার জন্য হলেও আপনার “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইটি একবার পড়া উচিত। এবং “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” পড়ার পর আপনার চিন্তা, বিশ্বাস এবং পরবর্তী কথা ও কাজগুলো আরো বেশি অর্থবহ হবে বলে আমি মনে করছি।

বাংলা ভাষায় লেখা যুক্তিবিদ্যা নিয়ে এত চমৎকার বই খুব কমই আছে বলে আমার জানা। যুক্তিবিদ্যার মত জটিল বিষয়টিকে এত সহজভাবে উপস্থাপনের বিষয়টি আসলে লেখকেরই মুন্সিয়ানা। “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইটির লেখক চমক হাসান মূলত গণিতের জন্য বিখ্যাত। আর এটাই হলো মজার বিষয়। কেননা গণিত ও যুক্তিবিদ্যা যেন একটি আরেকটির পরিপূরক। খুব নিবিড় একটা সম্পর্ক রয়েছে দুটি বিষয় এর মধ্যে। আর যেকোনো জটিল বিষয়কে সহজ, মজাদার ও আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপনের ব্যাপারে চমক হাসানের যেন জুড়ি মেলা ভার। লেখকের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (বিশেষ করে ইউটিউব) লক্ষ্য করলেই দেখা যায় গণিতের মতো জটিল বিষয়টিকে তিনি কিভাবে মানুষের কাছে সহজ, সুন্দর ও আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করছেন এবং নিয়মিত শিখিয়ে যাচ্ছেন কোটি কোটি শিক্ষার্থীকে। লেখক এর জন্য শুভকামনা জানিয়ে আজকে এখানেই শেষ করছি।
পড়ুন, জীবনকে উদ্যাপন করুন!
- বইঃ যুক্তিফাঁদে ফড়িং
- লেখকঃ চমক হাসান
- প্রচ্ছদঃ নিশাত বিনতে মনসুর
- প্রকাশনঃ আদর্শ
- পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১০২
- প্রথম প্রকাশঃ মার্চ, ২০২১
- পার্সোনাল রেটিংঃ ৯.৫/১০
- রিভিউ লিখেছেনঃ ইমরান হোসেন
“যুক্তিফাঁদে ফড়িং” যুক্তি আর ভ্রান্তির মজার দুনিয়ায় ডুব দেওয়ার এক দুর্দান্ত বই। হাসিব, এক বিতার্কিক যুবক, গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে, আর তার যুক্তির লড়াইয়ে যোগ দেয় কিছু কৌতূহলী শিক্ষার্থী। গল্প, ছন্দ, কমিক আর উদাহরণে ভরা বইটি শেখাবে যুক্তিবিদ্যার জটিল বিষয় সহজ ও বিনোদনমূলক উপায়ে। চমক হাসানের মুন্সিয়ানা এখানে স্পষ্ট—তিনি কঠিন বিষয়কেও উপভোগ্য করে তুলতে জানেন। বইটি পড়লে যুক্তি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য হবেন।